দারুচিনি দ্বীপ
Writer – Shuborna Jahan
“বক, পানকৌরী উড়ে বেড়ায় দিনভর
আকাশে পানে চেয়ে পাইনা শেষ প্রান্তর!
ক্ষণিক পরপর শ্বাস নিতে শূশূকের লাফালাফি
হঠাৎ কখন পানি ছুঁয়ে উড়ে গেলো ডাহুক পাখি!”

মাথার ভেতর এর চেয়ে সুন্দর কবিতা আসছিলো না তখন আর। কারন,আমার চোখে তখন প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি চলমান ছিলো। সবচেয়ে সুন্দর আমার কাছে।যার এই প্রথম প্রকৃতির এতো কাছে আসা। সমুদ্রের নীলে নীলে হারিয়ে যাওয়া এক অপার্থিব অনুভূতি। বেলা গড়াতে এখনো বেশ কিছু সময় বাকি।খুব মানুষ নেই বললেই চলে।আমি আনমনে হাটছিলাম। এই প্রথম আমার সমুদ্র পাড়ে ভ্রমন। প্রকৃতি আমায় বড্ড টানে। ভাবাতে শেখায়। কিন্তু চাইলে কি আর আসা যায় এতো কাছে! নেওয়া যায়! বুক ভরে সজীব নিশ্বাস? ঢাকা শহরে এ আর সম্ভব কোথায়। এসব ভাবতে ভাবতে হাটছিলাম। আমি সুবর্না জাহান । পড়াশোনা অর্ধেক পাঠ চুকিয়ে কেবল বের হলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বছর শেষ আর হাতে বিরতি সাথে সবার দরকার একটু স্বস্তির অবসর। ঠিক যেমন ভাবা তেমন কাজ। বন্ধুরা মিলে পাড়ি দেওয়া হলো সমুদ্রবিলাসের উদ্দেশ্য। সময়টা মে মাসের মাঝামাঝি। তাই পাহাড় জয়ের কথা কেউ ই মাথায় আনেনি। আমরা ১২ জন বন্ধু বেড়িয়ে পড়লাম ইটের শহর ছেড়ে। গন্তব্য দারুচিনি দ্বীপ। সুন্দর না নামটি? না আমার দেওয়া না।কথিত আছে সাত শতকের প্রথম ভাগে প্রতিকুল আবহাওয়ার মধ্যে এখানে দারুচিনি বোঝাই আরবের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ পানির নীচে থাকা একটি বিশাল পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে পড়ে। এতে করে জাহাজে থাকা দারুচিনি এই দ্বীপের সবখানে ছড়িয়ে যায় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট মারটিন’স দ্বীপের নাম হয়ে যায় ‘দারুচিনির দ্বীপ’। বিখ্যাত লেখক, কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এখানে “দারুচিনি দ্বীপ” নামে একটি চলচ্চিত্র ও নির্মাণ করেন।



“সেন্ট মার্টিন দ্বীপ” বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ (মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটার)।এবং এটাই বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।আর নিজেকে এখন মনে হচ্ছে এই প্রবাল দ্বীপের রানী। কংক্রিটের শহর ছেড়ে এসে এখানে কল্পনার রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রানী হয়ে থাকার ভাবনা মন্দ নয়।সে যাই হোক, আমাদের হুল্লোড়,আড্ডা সব ই সর্বদা চলছে। কিন্তু সব কিছুর মাঝখানে একবার নিজের মনে অনুভব করা হয়নি এই সমুদ্রকে। হাটতে হাটতে হঠাৎ পায়ের কাছে ঠেকলো ঝিনুক শামুক।অতিশয় সুন্দর জিনিস বলা যায়।এই যে এখন আমি ঝিনুক কুড়াবো এতে বাধ সাধার কেউ নেই।এতেও যে শান্তি বোধ কাজ করছে। এই শান্তির দ্বীপে আমরা ছিলাম ৪ দিন। এখানকার মানুষ, পরিবেশ সব কিছুই সুন্দর ও উপভোগের মতো ছিলো। আপনভাব ছিলো সব কিছুতেই।দেখার মতো আরো ছিলো “ছেড়া দ্বীপ”। জোয়ারের সময় এর এক তৃতীয়াংশ ঢুবে যায়।তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই দ্বীপে ক্যাম্পিং।এই দ্বীপে নানার রকম প্রবাল,নারিকেল গাছে পরিপূর্ণ। চতুর্থ দিনে আমাদের সন্ধ্যায় এই দ্বীপে ক্যাম্পিং এর প্লান হয়।পরদিন আমাদের বাস ছিলো ঢাকা ফেরার। আমরা যখন ছেড়া দ্বীপে পৌছাই বুঝতে পারলাম দিনটি পূর্নিমার দিন ছিলো। এতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ছিলো।চাঁদের আলোয় এই দ্বীপটি তখন আরো জাদুময় ও চাঞ্চল্যকর মনে হয়েছিলো। ক্যাম্পিং জুড়ে হলো গান-নাচ,আড্ডা। মূহুর্তগুলো আবার পাবো কিনা আমরা কেউ ই জানতাম না।তবে এর চেয়ে সুন্দর স্মৃতি কি আদৌ হতো! এই ভরা পূর্নিমায় আমরা ১২ জন মিলে যেনো ডুবে গেলাম। ভার্সেটির পর এই তো আমাদের শেষ হয়তো সময়। আমাদের ক্যাম্পিং এর শেষে গান ধরলাম আমরা সবাই মিলে।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা
প্রাণের মাঝে আয়,
মোরা সুখের দুখের কথা কব
প্রাণ জুড়াবে তায়..
পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কি রে হায়,
ঢাকায় রওনা দেওয়ার পূর্বে শেষ একবার সমুদ্রের সামনে আমি।বুক ভরে এই হাওয়া মনোনয়ন করলাম। এই অসীম নীল আকাশের সাথে নীল জলের মিতালী,সারি সারি নারিকেল গাছ আর নীল আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির দল। কবি জীবনানন্দ দাশ এই রূপকেই হয়তো বলেছে “সমুদ্রের জলে আমি দেহ ধুয়ে, চেয়ে থাকি নক্ষত্রের আকাশের পানে।”